তুরস্ক জীবনের যা কিছু বাংলাদেশে মিস করি তার মধ্যে অন্যতম – বোধহয় সবচাইতে বেশি – ইস্তানবুলের ক্যাফে জীবন। খুব কম দিনই গিয়েছে যে দিন অন্তত তিন-চার ঘণ্টা কোন না কোন ক্যাফেতে না গিয়েছে। ঝর-বৃষ্টি-তুষার, কোন কিছুই বিরত রাখতে পারে নি আমার ক্যাফে আড্ডাকে। বরং শোভা বৃদ্ধি করেছে সময়ে সময়ে। ভিন্ন ভিন্ন সময়ের জন্য ছিল ভিন্য ভিন্য ক্যাফে। দুপুরের রোদের জন্য এক ক্যাফে তো সন্ধ্যার আলো আধারির জন্য আরেক ক্যাফে। গ্রীষ্মের উষ্ণতার স্বাদ নিতে এক ক্যাফে তো শীতের শীতলতায় গুটি-শুটি মেরে বসার জন্য আরেক ক্যাফে। সিরিয়াস মানুষ সালাহউদ্দিন ভাই কিংবা সব দুষ্টামির ঠিকাদারি নেয়া মিনহাজ, প্রচণ্ড ব্যাস্ত হেলালি কিংবা শিল্পের প্রেমীক তুরকিশ বন্ধু বিলাল, আমার ক্যাফে জীবনের সঙ্গি হয়েছেন অনেকেই সময়ে সময়ে। হোক জীবনের গল্প বলা কিংবা সারা দিনের ক্লান্তি নিরসন, ক্লাসের হোমওয়ার্ক কিংবা কোন একাডেমিক প্রোজেক্টের পরিকল্পনা, শুধু দরকার ছিল বসার একটা উপলক্ষ। জীবনের একটা অংশ যে ক্যাফেগুলোতে কেটেছে তা শেয়ার না করলে কি হয়?

১। প্রেন্সেস ক্যাফে, মালতেপে।
ক্যাফে জীবনের আলোচনায় প্রথমে মালতেপের প্রেন্সেস ক্যাফেকেই উল্লেখ করতে হল। জীবনের গল্পগুলো সব ছড়িয়ে রয়েছে প্রেন্সেসের বাতাসে। কত স্বপ্নের জন্ম হয়েছে এখানে, কবর হয়েছে কত স্বপ্নের। সময় কাটানোর চমৎকার একটি স্থান। মালতেপে মেট্রো ষ্টেশনের পাশেই অবস্থিত প্রেন্সেসে গ্রাহকদের রুচিকে প্রাধান্য দিতে কোন কার্পণ্যই করেন নি ক্যাফে কর্তৃপক্ষ। সেটি তাদের চেয়ার-টেবিলের সেটআপ দেখলেই অনুমান করা যায়। সোফা-কাঠ-ষ্টীল-গ্লাস, গোলাকার কিংবা চতুর্ভুজ, ভিন্ন ভিন্ন রুচির মানুষের জন্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সেটআপ।
২। মাহফিল কিতাবেভি, উস্কুদার।

যদি জিজ্ঞেস করা হয় তুরস্কের একটি কিছুর নাম বল যা তুমি ওখানে যে অবস্থায় রয়েছে ঠিক সে অবস্থায় বাংলাদেশে তুলে নিয়ে আসতে চাও, তবে সেটি হবে উস্কুদারের মাহফিল কিতাবেভি। প্রতিটা ক্যাফেরি তাকে ভালো লাগার জন্য ছিল ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট। শুধু মাহফিল কিতাবেভি ছিল যাকে ভালো লাগার জন্য কোন বৈশিষ্টর প্রয়োজন হয় না। মাহফিল ছিল আমার জন্য পরিবারের মত। যখনি সেখানে গিয়েছি মনে হয়েছে ঘরে ফিরে এসেছি। ওয়ালিদে জাদিদ মসজিদের পশ্চিম পাশে ছোট্ট জায়গায় ছিমছাম আয়োজন। জানালার গ্রিল থেকে বাতির ঝার, সব কিছুতেই রয়েছে ঐতিহ্যের ছাপ। চা-কফি-জুস-বিভিন্ন ধরণের কেক, মেনু বলতে এই যা। ওদের সালেপ এখনো ঠোটে লেগে আছে যেন। একটা একাড্যামিক ভাব আছে ক্যাফেটার। ক্যাফের বইয়ের সংগ্রহ যথেষ্ট সমৃদ্ধ হওয়া ছাড়াও ক্যাফের গ্রাহকদের মাঝে বিশবিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রি আর শিক্ষকদের সংখ্যাই বেশি। মাঝে মাঝে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গ্রুপের প্রোগ্রাম থাকে ক্যাফেতে। ওয়ালিদে জাদিদ মসজিদের পশ্চিমের দেয়াল ঘেঁষেই ক্যাফের আউট-ডোর আয়োজন। রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলে না তেমন, তাই পরিবেশটাও বেশ শান্ত।
৩। নেভমেকান, বালারবাশি।

“কনজারভেটিভদের স্টারবাক্স” হিসেবে খ্যাত নেভমেকানের বাহচের মত এত সুন্দর সন্ধ্যা ইস্তানবুলের আর কোথাও হয় কি না জানা নেই। টেবিলে মোমবাতি, ঘাস ছাওয়া দেয়ালে নিয়ন বাতি; গ্রাহকের সন্ধ্যাগুলোকে নববধূর সাঁজ দিতে কোন আয়োজনের কমতি রাখেনি কর্তৃপক্ষ। উস্কুদার সিটি-কর্পোরেশনের দ্বারা পরিচালিত এই ক্যাফে-রেস্টুরেন্টটি ষাটের দশক পর্যন্ত ট্রামভাই ডিপো, তারপর দীর্ঘ সময় বাসের ওয়ার্কশপ ছিল। তাই বিল্ডিং থেকে শুরুকরে বইয়ের র্যাক-সিঁড়ি-চেয়ারটেবিল, সব কিছুতেই একটা নস্টালজিক ছোঁয়া রয়েছে। আছে প্রচণ্ড আভিজাত্যও। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে ওখানে না যাওয়ার পরামর্শ থাকলো। সে সময় ওটা ছাত্র-ছাত্রীদের দখলে থাকে।
৪। পেশরেভ বালারবাশি।

পরন্ত দুপুরে আঙুর লতার ছায়ায় বসতে কার না ভালো লাগে বলুন। সামনে থেকে দেখতে আর পাঁচটা ক্যাফের মত মনে হলেও পেশরেভের আসল সৌন্দর্য লুকানো তার আঙুর-লতায় ছাওয়া বাগিচায়। মাঝারি আকারের একটা চিনার গাছ আর আঙুরের মাচার নিচে পাতা হয়েছে চেয়ার টেবিল। রোদেলা দুপুরের আলো-ছায়া ছাড়াও আঙুর-মাচায় ঝোলানো বাতির নিচে পেশরেভের আলো-আধারির রাতগুলোও অসম্ভব সুন্দর।
৫। কেমাহ উস্কুদার।

রাস্তার পাশে ছোট্ট একটু জায়গা, সব মিলিয়ে চার-পাঁচ জন লোক বসার অবস্থা রয়েছে ভিতরে। এই ছোট্ট জায়গাটুকই বিকেলে হয়ে উঠত অনেকের ঠিকানা। দোকানের সামনে রাস্তা, রাস্তার পরে নিচু করে ফুটপাতের মত একটু জায়গা, সেখানে বিশাল এক গাছ। বিকেল গড়াতেই এই গাছের নিচে ছোট ছোট টুল আর তেপায়া পাতা হত। চায়ের কাপ ছিল মাত্র এক লিরা। কেমাহ আসলে ক্যাফে নয়, ছিল মহল্লার চায়ের দোকান। তবে দুঃখের সংবাদ হচ্ছে উস্কুদার বেলেদিয়ের নতুন প্রোজেক্টের কারণে দোকানটি আর নেই। একটু পাশেই কেমাহ নামে আরও বড় পরিসরে একটা চায়ের দোকান করা হয়েছে যদিও, তবে আগের কেমাহের সেই বিকেল নতুন কেমাহে পাওয়ার যো নেই।
৬। পাচি ক্যাফে, উস্কুদার সাহিল।

গ্রীষ্মের সকাল-দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যা-রাত, যখনি বসফরাসের সাথে আড্ডা দিতে ইচ্ছে হবে চলে যাবেন পাচি ক্যাফেতে। দুপুরে বসফরাসের নীল জল, বিকেলে সে জলের উপর রোদের সোনালী আলোর নেচে বেড়ানো, সন্ধ্যায় লাল-নীল আলোয় সজ্জিত বসফরাস ব্রিজ; সব কিছু পাবেন এখানে। এই এক জায়গা যেখানে আমি একা যেতেই বেশি পছন্দ করতাম। সহজ ভাষায় বললে আর সব ক্যাফে ছিল আমার অন্যদের সাথে আড্ডা দেয়ার জায়গা, আর পাচি ছিল নিজের সাথে আড্ডা দেয়ার জগত। আর হ্যাঁ, অবশ্যই মোটা মনিব্যাগ সাথে থাকতে হবে। বসফরাসের পাড়ে রেস্টুরেন্ট, বুঝতেই পারছেন। অবশ্য আমার মত শুধু চা খেয়ে নির্লজ্জের মত ঘণ্টা পার করে দেয়ার সাহস থাকলে পাতলা মানিব্যাগেও চলবে।
৭। মিহরিমা ক্যাফে, উস্কুদার।

শুধু উস্কুদার কিংবা ইস্তানবুল নয়, তুরুস্কের প্রসিদ্ধ ক্যাফেগুলোর একটি বিবেচনা করা হয় মিহরিমাহ ক্যাফেকে। পুরো ক্যাফে জুড়ে ওসমানীয়ও হেরেমের একটা আবহ পরিবেশ তৈরি করে রাখা হয়েছে। এমনকি কফির স্বাদেও রয়েছে ভিন্যতা। মাহফিল কিতাবেভির পাশেই হওয়ায় খুব কম যাওয়া হয়েছে মিহরিমায়। তবে যখনি গিয়েছি বেড় হতে কষ্ট হয়েছে বেশ।
৮। সুলেমানীয়ে চিকলাতাজিসি, ভেজনিজিলার।

ওসমানীয়ও ঐতিহ্যের কথা উঠলে আরেকটি ক্যাফের কথা বলতেই হয়- ইস্তানবুল ইউনিভার্সিটির পাশেই ভেজনিজিলারের সুলেমানীয়ে চিকলাতাজিসি। পাটের রশি দিয়ে সেলাই করা খাবার মেনু, কাঠের ট্রে, দেয়ালে ক্যালিগ্রাফি, ঘরের মেঝেতে পানির ফোয়ারা – গ্রাহকদেরকে ওসমানীয় ঐতিহ্যের স্বাদ দিতে সম্ভাব্য সব কিছুর ব্যবস্থা করা হয়েছে। চকলেট কিংবা কফি, ওদের তুলনা পাওয়া মুস্কিল। ওখানে যাওয়ার সুযোগ পেয়েও ওদের শরবৎ না খেয়ে যদি আসেন; আপনার তুরস্ক ভ্রমণ অপূর্ণ রয়ে যাবে।