বছর দুয়েক আগের কথা। সামার ভ্যাকেশনে বাংলাদেশে বেড়াতে গেলাম। মোটামুটি চিল মুডে ঘুরছি ফিরছি। এরই মধ্যে মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া এক আত্মীয় বেশ গম্ভীর গলায় কেন ইউরোপের অন্য জায়গা বাদ দিয়ে ইস্তাম্বুল ঘুরবেন তার ১০ টি কারণ জানতে চাইলেন। আমি তার থেকেও বেশি ভারিক্কি স্বরে নিজের চশমা নাকের ডগায় বসিয়ে বললাম-মোটে ১০ টি! Grow up man! তাকে নামাতার মতো গড়গড়িয়ে ১০১ টা কারণ দেখিয়ে দিলাম, সাথে এটাও যোগ করলাম, আমি প্যারিস ঘুরে এসে রুমমেটকে মুখ বাকিয়ে বলেছিলাম- প্যারিস সুন্দর তবে ইস্তাম্বুলের তুলনায় নিতান্তই শিশু! কেন এই ঘটনা দিয়ে শুরু করলাম ? কেনো নয় বলুন তো! ইউরোপ দেখতে চান? ইস্তাম্বুল আসুন। আচ্ছা, এশিয়া ভালো লাগে? আসুন। পুরানো শহর? আসুন । আধুনিক শহরের জীবন যাত্রা? আসুন। খ্রিস্টান কিংবা মুসলিম ঐতিহ্য? তাড়াতাড়ি আসুন! অবিশ্বাস্য রকম মোহনীয় এবং মন্ত্রমুগ্ধকর ট্যুরিস্ট স্পট খুঁজছেন? আরেহ ব্রাদার- ইস্তাম্বুলের মতো মাস্টারপিস আর কই পাবেন! নেপোলিয়ান তো আর এমনি এমনি বলেন নি – “If the earth were a single state, Istanbul would be its capital”
ইস্তাম্বুল শহর দুটি মহাদেশে বিস্তৃত হওয়ার কারণে এটি অবাক হওয়ার মতো বিষয় নয় যে এই শহর অগণিত ঐতিহাসিক তাৎপর্য ধারণ করে। ইস্তাম্বুল এসেই যে তিনটি স্থাপনা দেখা ফরয (কথা সত্য!) সেগুলো হলো- সুলতানাহমেত মসজিদ, হায়া সোফিয়া এবং তোপকাপি প্রাসাদ। ইস্তাম্বুলের সুলতানাহমেত মসজিদ Blue Mosque নামেও পরিচিত। ভাবছেন কেন এটিকে নীল মসজিদ বলা হয়েছে? আমিতো প্রথম বার গিয়ে আঙ্কেলগুড়ুম কারণ এর বাহ্যিক অংশে নীল রঙের “ন” ও নেই! আর ভিতরে ঢুকেই আমার চক্ষুগুড়ুম! পুরো ইন্টেরিয়রটাই ডিজাইন করা হয়েছে নীল টাইলস দিয়ে। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য মানুষকে বোবা করে দেয়- এটি আমি Blue Mosque এ টের পেয়েছি। এটি অটোমান সুলতান আহমেদ (১৬০৯ -১৬১৬) সময়কালে নির্মিত। মসজিদের অভ্যন্তরটি প্রায় ২০,০০০ এরও বেশি হস্তনির্মিত সিরামিক টাইলস দিয়ে সজ্জিত, যা অটোম্যান সাম্রাজ্যের সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক স্বত্তার প্রতিনিধিত্ব করে। এছাড়া ডোমের ভেতরের অংশ প্রায় পুরোটাই নীল। মসজিদে রয়েছে প্রায় দু’শোটি জানালা। ভেতরে অজস্র ঝাড়বাতি। এই আলো নীল রঙের টাইলসে পড়ে এক অপূর্ব সুন্দর মোহময় পরিবেশের সৃষ্টি করেছে।

একসময় বিশ্বের বৃহত্তম ক্যাথেড্রাল, তুরস্কের ইস্তাম্বুলের হায়া সোফিয়া ১৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর (Orthodox, Catholic, Muslim) জন্য সমান গুরুত্ব বহন করে বসফরাসের তীরে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রিক ভাষায় হায়া মানে পবিত্র আর সোফিয়া মানে জ্ঞান। হায়া সোফিয়া কে বলা হয় সম্প্রীতি, শান্তি এবং সহনশীলতার প্রতীক। হায়া সোফিয়ার দেয়ালগুলি একই সাথে ইসলামীক আর্ট এবং খ্রিস্টধর্মের প্রতীকের একটি মিশ্রণ উপস্থাপন করে। ষষ্ঠ শতাব্দীতে (৫৩২-৫৩৬) নির্মিত হায়া সোফিয়া এক সময় চার্চ হিসেবে , ১৪ শতকে এটা মসজিদ হিসেবে এবং আজ এটি একটি যাদুঘর হিসেবে জনপ্রিয়।
ব্লু মসজিদ আর হায়া সোফিয়া সোফিয়ার পাশেই আছে বিশাল তোপকাপি প্রাসাদ। আমার ব্যাক্তিগত উপলব্ধি-তোপকাপিকে প্রাসাদ না বলে একটা ছোটখাটো শহর বলাই ভাল! পাক্কা দুই ঘন্টার উপর লেগেছিল পুরোটা ঘুরতে। এবার একটু বিনামূল্যে জ্ঞান বিতরণের পালা! উসমানীয় সাম্রাজ্যের শাহেনশাহ দ্বিতীয় মুহাম্মাদ পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে তোপকাপি প্রাসাদের নির্মাণকাজ শুরু করান। তোপকাপি প্রাসাদ সত্যিকার অর্থে উসমানীয় শাসনামলের দৌর্দণ্ড প্রতাপের প্রতিচ্ছবি। উসমানিয়া সুলতানরা এই প্রাসাদ নিজেদের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করতেন। তাদের শাসনকার্য পরিচালনাতেও এই প্রাসাদ গুরুত্বপূণ হয়ে ওঠে। গোটা ইস্তানবুলের প্রশাসনিক ও শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহার করা হয় এই প্রাসাদ। প্রায় ৪০০ বছর ধরে এটি উসমানীয় সুলতানদের বাসস্থান হিসেবে বিদ্যমান থাকে।তোপকাপি প্রাসাদ ‘ইস্তানবুলের ঐতিহাসিক এলাকা’ হিসেবে ১৯৮৫ এ ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষিত হয়।বর্তমানে এই প্রাসাদটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এখানে রয়েছে মুসলমানদের জন্য পবিত্র স্মরণচিহ্ন যেমন, হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর আলখাল্লা এবং তরবারি, তীর-ধনুক, দাঁত ও দাড়ির একটি চুল রাখা আছে I এখানে হজরত মুসা আঃ এর লাঠি, হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর জামাতা হজরত আলি রাঃ এর জামা, কারবালা যুদ্ধের মাটি, কাবার চাবি রাখা আছে।

তুরস্কের বসফরাস ব্রিজের ঠিক সামনে অবস্থিত, তুরস্কের অর্টাকয় মসজিদ (Ortaköy Mosque) যতোটা ঐতিহাসিক ঠিক ততটাই সুরম্য। মসজিদটি এবং এর আশপাশের পরিবেশ এত্ত নজরকাড়া যে, আর কিছুর জন্য না হোক, অন্তত ছবি তোলার জন্য হলেও প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক এখানে আসেন। আমি তাই এর নাম দিয়েছি Most Instagrammable spot! যারা সিনেমাপ্রেমি আছেন তারা ইতিমধ্যেই এই জায়গাটি অনেক সিনেমাতে দেখে ফেলেছেন।

ইস্তাম্বুলের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থাপনা ডলমাবাহছে প্রাসাদটি বসফরাসের তীরে অবস্থিত। ১৮৪২ সালে নির্মিত প্রাসাদটির দৃষ্টিনন্দন চেহারা আজও চিত্তাকর্ষক। তুরস্কে প্রজাতন্ত্রের ঘোষণার পরে এটি তুর্কি প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা, মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের রাষ্ট্রপতি প্রাসাদে পরিণত হয়েছিল। ১০ নভেম্বর, ১৯৩৮ সালে সকাল ৯:০৫ টায় মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক এই প্রাসাদে মারা গিয়েছিলেন। এই কারনে প্রাসাদ টি সমস্ত তুরস্কের হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান দখল করে রেখেছে। প্রাসাদটি ইউরোপীয় স্থাপত্য শৈলীর সংমিশ্রণ প্রদর্শন করে। এখানে ২৮৫ টি কক্ষ এবং ৪৩ টি হল রয়েছে, পাশাপাশি প্রাসাদে সুবিশাল দুটি অসাধারণ কারুকার্যের গেট রয়েছে। প্রাসাদটি ফায়ারপ্লেস, মোমবাতি ধারক এবং ঝাড়বাতিতে পূর্ণ। বলরুমে একটি বিশাল স্ফটিক ঝাড়বাতি রয়েছে যার ওজন ৪.৫ টন, যা মূলত রানী ভিক্টোরিয়া উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন এবং এটিকে বলা হয়ে থাকে বিশ্বের বৃহত্তম বোহেমিয়ান স্ফটিক ঝাড়বাতি।

আপনি যদি পুরো ইস্তাম্বুলের ৩৬০ ডিগ্রি প্যানোরামিক দৃশ্য দেখার ইচ্ছে পোষণ করে থাকেন তবে গ্যালাতা টাওয়ারের শীর্ষের চেয়ে ভাল জায়গা আর নেই। চোখ বন্ধ করে উঠে পড়ুন ১৩৪৮ সালে নির্মিত মধ্যযুগীয় এই পাথুরে টাওয়ারটি তে। নয়তলা বিশিষ্ট গোল এই টাওয়ারটির উচ্চতা প্রায় ২২০ ফুট, যখন এটি নির্মিত হয়েছিল- ইস্তাম্বুলের দীর্ঘতম কাঠামোর প্রতিনিধিত্ব করেছিলো। মূলত এটি সামরিক উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল, আর তাই এর দেয়ালগুলি বেশ পুরু (প্রায় ১২ ফুটের মতো!)।
ইস্তাম্বুলের প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘরগুলি চেক আউট করেছেন তো? ইস্তাম্বুলকে “বিশ্বের বৃহত্তম ধ্রুপদী নিদর্শনের সংগ্রহশালা” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘরগুলিতে ইস্তাম্বুলের এমন কিছু লুকানো রহস্য আছে, যা প্রায়শই পর্যটকরা স্কিপ করে যান। এই ভুল করলে বিশাল বোকামির কাজ করবেন আগেই বলে রাখলাম। কেন? নোবেল জয়ী তুর্কি লেখক Orhan Pamuk কি বলেছেন মনে নেই! “Real museums are places where Time is transformed into Space”, তাই আর কিছু না হোক অন্তত The Archaeology Museum, Museum of the Ancient Orient, এবং Museum of Islamic Art এই তিনটি মিউজিয়াম ঘুরতে ভুলবেন না। মিউজিয়াম গুলো হলো মূলত এই অঞ্চলের ইতিহাস সম্পর্কে আরও কিছুটা জানার দুর্দান্ত জায়গা। আপনি ইস্তাম্বুলের মতো শহর আর পাবেন না, যার ইতিহাস একই সাথে রোমান, গ্রীক এবং অটোমান প্রভাবে সমৃদ্ধ। তাহলে বুঝুন মিউজিয়াম গুলোর গুরুত্ব কতটুকু।
ইস্তাম্বুলের বসফরাসের তীরে বা Üsküdar এর কিজ কুলেসির সামনে সূর্যাস্ত দেখতে গেলে একজন কাঠখোট্টা মানুষও প্রেমের কবিতা লিখে ফেলতে পারেন। আমার মতে কবিতা না, আস্ত বই লিখে ফেললেও অবাক হবার কিছু নাই! সূর্যাস্ত দেখার জন্য এইসব স্পট একেবারে যাকে বলে সোনায় সোহাগা, আর আমি বলি Killer spot! প্রকৃতির এক অপূর্ব সৃষ্টি বসফরাস প্রণালী যার এক দিকে সি অফ মারমারা, অন্য দিকে কৃষ্ণসাগর। আর এই তিনের মাঝেই ইস্তানবুল। এটি বিভক্ত করেছে পূর্ব ও পশ্চিমকে , ইউরোপ এবং এশিয়া কে , তবে সংযুক্ত করেছে মানুষ এবং প্রকৃতিকে । সূর্যাস্তের পাশাপাশি আপনি নৌযান চলাচলকারী, সামুদ্রিক সিগাল, ফেরি পেতে ছুটে চলা লোকগুলি কিংবা মাছ ধরা দেখতে পারেন। সারাদিনের ঘুরাঘুরির পর সন্ধ্যাটা প্রিয় মানুষের কাঁধে মাথা রেখে, কফির মগে চুমুক দিয়ে, ঢেউ এর গান শুনে কিংবা ভালবাসার মানুষটির হাতে হাত রেখে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনতে চান? হ্যাঁ, আপনার জন্যই সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে দু হাত মেলে অপেক্ষা করছে Üsküdar.
ইস্তানবুল গিয়েছেন তবে ইস্তিকলাল অ্যাভিনিউ যাননি এমন মানুষ পাওয়াই যাবেনা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে এই একক এভিনিউটি প্রতি দিন প্রায় ৩ মিলিয়ন লোক পরিদর্শন করেন! ইস্তানবুলের সবথেকে বিখ্যাত এই রাস্তা, শুধুমাত্র পথচারীদের চলার জন্য। এই তিন কিলোমিটার লম্বা রাস্তাটার দু’ধারে সুন্দর সুন্দর পুরনো ইউরোপীয় নিওক্লাসিক্যাল বাড়ি, ব্যুটিকের দোকান, আর্ট গ্যালারি, থিয়েটার, লাইব্রেরি, কফিহাউস— কী নেই!
পর্যটকদের বাকেট লিস্টে গ্র্যান্ড বাজার সব সময়েই উপরের দিকে থাকে ।গ্র্যান্ড বাজারে কী পাওয়া যায়, আর যায় না, তা নিয়ে বোধ হয় মাথা না ঘামানোই ভাল! এটি সুলতান মেহমেদ দ্য কনকরার তৈরি করেন ১৪৬১ সালে। প্রায় ষাটটি গলি বিশিষ্ট এই বাজারে এক বার না এক বার রাস্তা হারানো খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। প্রতিদিন প্রায় লাখ চারেক মানুষ এখানে আসেন— মূলত পর্যটক, আর স্থানীয়রা তো আছেনই! কার্পেট, চামড়ার কোট, পোর্সেলিনের থালা-বাটি, ভেলভেটের টুপি, জুতো, রং বেরঙের লন্ঠন, সোনা, মুক্তোর দোকান— একেবারে মাথা নষ্ট অবস্থা! তবে কিনা – সব কিছুই কিনতে হয় দরদাম করে।

ইস্তাম্বুলকে বলা হয় মায়ার শহর। আর আমি বলি “City of Fantasy and Reality”. বসন্তের কোনো এক গোধূলি লগনে Emirgan পার্কে হাজারো টিউলিপের মাঝে বসে একটি বইয়ে পড়েছিলাম ইস্তাম্বুল জয়ী বীর ফাতিহ সুলতান মেহমেদের একটি উক্তি – “Either I conquer Istanbul or Istanbul conquers me.” কেনো যেনো কথা টি খুব মনে পড়ছে আজ। বুড়ো বয়সে ইজি চেয়ারে দোল খেতে খেতে লাখো মানুষের মতো আমারো মন জয় করে নেওয়া ইস্তাম্বুলের অলিগলির গল্প নাতি নাতনিদের শুনাতে পারবো একদিন। নাহ, জীবনটা মন্দ নয়!